লিখেছেন – প্রদীপ কুমার হাঁসদা|
পুরো নাম Paul Olaf Bodding (পৌল অলাফ বোডিং ), সংক্ষেপে P.O. Bodding বা পি.ও. বোডিং| সাঁওতাল আদিবাসীরা তাঁকে ডাকতেন পিয়ো বোডিং সাহেব বলে| এই পি.ও বোডিং সাহেব আদিবাসী সাঁওতাল সমাজে একজন শিক্ষার বাহক বা শিক্ষার দূত হিসেবে এসেছিলেন।
পি.ও. বোডিং ছিলেন একজন ভাষাবিদ, লোকাচারবিদ, গবেষক, বিজ্ঞানী| পি.ও বোডিং আদতে একজন নরওয়েজিয়ান মিশনারী| তিনি ২ নভেম্বর ১৮৬৫ সালে নরওয়ের গজোভিক শহরে জন্মগ্রহণ করেন| তার বাবার নাম এডওয়ার্ড ওলসেন বোডিং এবং মা বেটজি এমিলি ওয়েইনভোল্ট। বাবা ছিলেন গজোভিক শহরের একজন বই বিক্রেতা। সাঁওতালি ভাষা ও সাহিত্য গবেষনার অগ্রদূত Lars Olsen Skrefsrud বা L.O. Skrefsrud ছিলেন পি.ও বোডিং এর বাবার বন্ধু। এই L.O. Skrefsrud কে সান্তালরা কেরাপ ( Kerap) সাহেব নামেই জানে। ১৮৮১-৮২ সালে L.O. Skrefsrud নরওয়েতে থাকাকালে পি.ও বোডিং তাঁর কাছে ভারতের সাঁওতাল জাতি সম্পর্কে জানতে পারেন। তিনি ঐ সময় সাঁওতালদের কাছে আসার জন্য তাঁর ইচ্ছা ও আগ্রহের কথা প্রকাশ করেন। পি.ও বোডিং ১৮৮৯ সালে ক্রিশ্টিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় (আধুনা অসলো বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে স্নাতক হন।
১৮৯০ সালের জানুয়ারি মাসে একজন খৃষ্টান মিশনারি পাদ্রি হিসেবে পি.ও. বোডিং ভারতের সাঁওতাল পারগানা (Santal Pargana) অঞ্চলে আসেন এবং একই বছরের ডিসেম্বর মাসে মহুলপাহাড়িতে মিশনের দায়িত্ব গ্রহন করেন। ১৯০৯ সালে Lars Olsen Skrefsrud মারা গেলে, নরওয়ী খৃষ্টান মিশনারি সংস্থা Santaline Mission বা সান্তাল মিশনের নেতা হিসেবে পি.ও. বোডিং ক্ষমতা গ্রহন করেন এবং সান্তাল মিশনের প্রশাসনিক কেন্দ্র টি দুমকা জেলাতে স্থানান্তর করেন।
সাঁওতালি ভাষাকে নিয়ে গবেষণা করার প্রবল ইচ্ছা ও আগ্রহ ছিল পি.ও বোডিং এর। পি.ও বোডিং ৪৪ বছর ধরে নিরলস ভাবে সাঁওতালদের মধ্যে থেকে কাজ করে গেছেন। সাঁওতালি ভাষাভাষী লোকজনের জন্য তিনিই প্রথম রোমান হরফে সাঁওতালি বর্ণমালা ও ব্যাকরণের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দাড় করিয়েছেন।১৯১৪ সালে বাইবেলকে সাঁওতালি ভাষায় অনুবাদ করেন পি.ও. বোডিং| তবে পি.ও. বোডিং এর সব থেকে উল্লেখযোগ্য কাজ হলো সাঁওতালি ভাষার শব্দ সংরক্ষণ করে সাঁওতালি ভাষার অভিধান বা Santali Dictionary রচনা করা, যার জন্য আদিবাসী সাঁওতাল সমাজ চিরদিন পি.ও. বোডিং এর কাছে ঋণী থীকবে| ১৯২৩ সালে পি. ও. বোডিং পাঁচটি খণ্ডের একটি সাঁওতাল অভিধান (Santali Dictionary) তৈরী করেন। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একজন গবেষক হিসেবে পি.ও বোডিং সাঁওতাল জাতির জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। সাঁওতালদের মুখে মুখে প্রচলিত সাহিতের লিখিত রুপ দান করেছেন।
তার সৃষ্টিকর্ম গুলির মধ্যে হলো :
(1) Studies in Santal Medicine and Connected Folklore.
(2) Santal Medicine.
(3) Folklore of the Santal Parganas.
(4) A chapter of Santal Folklore.
(5) A Santal Dictionary.
(6) The Santals and Disease.
(7) Santal Riddles and Witchcraft among the Santals.
(8) Santal Folk Tales.
(9) Traditions and Institutions of the Santals (Hoṛ Koren Mare Hapṛam Koak̕ Katha)
(10) Kukli Puthi.
(11) Sereng Puthi.
(12) Hor Kahniko.
(13) Baebel Translation.
(14) Materials for a Santali Grammar.
(15) A Santali Grammar for Beginner’s.
এছাড়াও আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ রচনা সৃষ্টি করে গেছেন|
পি.ও. বোডিং ১৮৯৩ সালে বাংলার এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য এবং ১৮৯৪ সালে ক্রিশ্টিয়ানা ( বর্তমানে Norwegian Academy of Sciences) – এর সদস্য হন। ১৯০৭ সালে তিনি ব্রিটিশ ও ফরেন বাইবেল সোসাইটি লন্ডনের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন।
তিনি ১৯০১ সালে King Oscar স্বর্নপদক লাভ করেন। ১৯১০ সালে Order of St. Olav – এর প্রথম শ্রেনীর নাইট উপাধি লাভ করেন। ১৯১২ সালে তিনি দিল্লী দূর্বার ( Delhi Durbar) পুরস্কার পান এবং ১৯৩১ সালে ফ্রেডজোফ নানসেন পুরস্কার লাভ করেন।
এই প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও গবেষক ভারতের ঝাড়খণ্ড, বিহার, আসাম, উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ, রাজ্যগুলিতে এবং বাংলাদেশ ও নেপালের সাঁওতালদের নিকট অত্যন্ত জনপ্রিয়|
স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলিতেও ( নরওয়ে, ডেনমার্ক, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, দেশগুলিকে স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশ বলা হয়) তিনি এখনও বেশ সুপরিচিত।
আরো জানা যায়, সাঁওতালদের ভাষা ও ব্যাকরণকে কেন্দ্র করে মিশনারিদের সাথে পি. ও. বোডিংয়ের মতের মিল ছিলনা। যারফলে তাকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় বলে অভিযোগ| ভারত ত্যাগ করার পূর্বে বিদায় মুহূর্তে তিনি কান্নাভেজা কণ্ঠে তার সাঁওতাল প্রীতি এবং সাঁওতালদের ত্যাগ করে চলে যাওয়ার দূঃখ সাঁওতালদের কাছে প্রকাশ করেন।
১৯৩৪ সালে পি.ও. বোডিং তার ডেনিশ স্ত্রী ক্রিশ্টিন লারসেন কে নিয়ে ডেনমার্কের ওডেন্সে জীবন যাপন করেন। এখানেই ১৯৩৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর পরলোকগমন করেন পি.ও. বোডিং। তাকে ওডেন্সের কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
এই মহান পন্ডিত ব্যক্তি সাঁওতালদের জীবনে শিক্ষার আলোর দেবদূত হয়ে এসেছিলেন। তিনি সাঁওতাল জাতির হৃদয়ে, চিরদিন বেঁচে থাকবেন দেবতার আসনে।
২ নভেম্বর তাঁর জন্মদিন| বিভিন্ন জায়গায় এই দিনটি গুরুত্বের সাথে পালন করা হবে। তবে ২ নভেম্বর ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের মৃত ব্যক্তিদের স্মরণ দিবস ( All Souls Day) পালিত হয়। যারফলে অনেক জায়গায়, ২ তারিখের পরিবর্তে ভিন্ন তারিখে পি. ও. বোডিং জন্মদিন টি উদযাপিত হয়।
তথ্যসূত্র – ইন্টারনেট ও উইকিপেডিয়া|