LOADING

লাল হেমরম: সাঁওতাল পরগণা – হাজারিবাগ লোকসভার প্রথম সাংসদ, ব্রিটিশ দের বিরুদ্ধে লড়াইের জন্য সেনা গঠন করেছিলেন|

Spread the love

লিখেছেন – প্রদীপ কুমার হাঁসদা, কেন্দ্রীয় সভাপতি, ভারত দিশম মাঝি মাডোয়া|

স্বর্গীয় লাল হেমরম ছিলেন একধারে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী, আদিবাসী সমাজ সংস্কারক আন্দোলন “সাফা হড় আন্দোলন” এর নেতা, সাঁওতাল পরগণা – হাজারিবাগ লোকসভার প্রথম আদিবাসী সংসদ, স্বাধীনোত্তর সাঁওতাল পরগণা – হাজারিবাগ লোকসভা কেন্দ্রের বিকাশ পুরুষ| লাল হেমরম তার অনুগামীদের কাছে পরিচিত ছিলেন “লাল বাবা” নামে|
১৯১৪ সাল নাগাদ বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দুমকা লোকসভার অন্তর্গত সরায়দাহা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এই মহান আদিবাসী নেতা লাল হেমরম|
আদিবাসী মানুষদের দুঃখ দুর্দশা লক্ষ্য করে শুরু করেছিলেন সমাজ সংস্কারক আন্দোলন “সাফা হড়” তথা মানুষ শুদ্ধি আন্দোলন| লাল হেমরম তথা লাল বাবা মানুষদের সাদা পতাকা বিতরণ করতেন, যাবতীয় নেশা বর্জন করতে বলতেন, অনাচার ব্যাভিচার থেকে দূরে থাকতে বলতেন, পূজোর স্থান পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে উপদেশ দিতেন|
অচিরেই লাল হেমরম বুঝতে পারলেন যে শুধুমাত্র সমাজ সংস্কার আন্দোলন করে এই দেশের মানুষদের উন্নতি করা যাবে না কারণ এই দেশ পরাধীন হয়ে আছে| বিদেশী ব্রিটিশরা এই দেশকে পরাধীন করে রেখেছে, এই দেশের মানুষকে শাসন শোষণ করছে, এই দেশের সম্পদকে লুট করে ইংল্যান্ডে পাচার করছে| এই দেশের মাটি থেকে বিদেশী ব্রিটিশদের তাড়িয়ে এই ভারতবর্ষকে স্বাধীন না করলে এই দেশের মানুষদের মুক্তি হবে না| বিদেশী ব্রিটিশদের তাড়িয়ে মাতৃভূমি ভারতবর্ষকে স্বাধীন করতে লাল হেমরম গঠন করেছিলেন “লাল সেনা” নামে মুক্তি বাহিনী| লাল হেমরমের নেতৃত্বে “লাল সেনা” ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করল| সাঁওতাল পরগণার লাঠি পাহাড় ছিল লাল সেনার ঘাঁটি| লাল সেনার দাপটে ব্রিটিশ সরকার ব্যাতিব্যস্ত হয়ে পড়ল| লাল হেমরমের নেতৃত্বে “লাল সেনা” ডাকঘর, থানা, কর আদায় অফিস লুট করে জ্বালিয়ে দিত| ব্রিটিশ পুলিস লাল হেমরমকে ধরতে ব্যাপক অভিযান চালায় কিন্তু ব্যর্থ হয়|
১৯৪২ সালে গান্ধীজী ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে “ভারত ছাড়” আন্দোলনের ডাক দেয়| এই সময় আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে লাল হেমরম| লাল হেমরমের নেতৃত্বে লাল সেনা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে হামলা আরো তেজ করে| সরকারি অফিস, কাছারি ঘর সব লুট করে জ্বালিয়ে দিতে থাকে লাল সেনারা|
খবর পেয়ে বিহারে ছুটে আসেন খোদ গান্ধীজী, আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দেন লাল হেমরমকে| গান্ধীজীর আদেশ মেনে আত্মসমর্পণ করেন লাল হেমরম| স্বস্তির নিংশ্বাস ফেলে ব্রিটিশ সরকারের পুলিস| বিচারে ৫০ বছরের সাজা হয় লাল হেমরমের|
১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করলে মুক্তি পান লাল হেমরম| ১৯৫২ সালের প্রথম লোকসভা নির্বাচনে সাঁওতাল পরগণা – হাজারিবাগ আসন থেকে কংগ্রেস দলের পক্ষ থেকে প্রার্থী হন ও বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন| তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু অত্যন্ত স্নেহ করতেন লাল হেমরমকে| এলাকার মানুষের কাজে প্রায় প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জহরলাল নেহেরুর কাছে যেতেন লাল হেমরম| প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু নিজের নিরাপত্তা রক্ষীদের বলে রেখেছিলেন যে দোহাতী বেশভূষাধারী লাল হেমরম দেখা করতে এলে যেন না আটকানো হয়|
সাংসদ হিসেবে লাল হেমরম নিজের সংসদীয় ক্ষেত্রে কলেজ নির্মানের জন্য প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জহরলাল নেহেরুকে অনুরোধ জানান| লাল হেমরমের ইচ্ছা অনুসারে প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু সাঁওতাল পরগণা কলেজ (Santal Pargana College) নির্মান করান| কলেজ নির্মানের পর প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু লাল হেমরমের নামে কলেজের নানকরণ করতে চাইলে লাল হেমরম বলেন, কলেজের নাম হোক সাঁওতাল পরগণার নামে| সেই ভাবে নবনির্মিত কলেজের নাম হয় সাঁওতাল পরগণা কলেজ (Santal Pargana College)|
শুধু সাঁওতাল পরগণা কলেজ (Santal Pargana College) নয়, লাল হেমরমের উদ্যোগে স্থাপিত হয় দামোদর উপত্যকা নিগম, রাজকীয় পলিটেকনিক, ম্যাসেঞ্জার বাঁধ| নিজ গ্রামের একমাত্র স্কুলটিও লাল হেমরমের উদ্যোগে স্থাপিত হয়েছে| ১৯৬৭ সালে মারা যান এই মহান মানুষটি|
এই মহান মানুষটি সবার জন্য কাজ করে গেলেও নিজের জন্য কিছুই করেননি| সারা জীবন মাটির বাড়িতে থেকেছেন| তাই হয়তো আধুনা সমাজ লাল হেমরমের মতন মানুষকে ভুলে গেছে| লাল হেমরমের মতন মানুষকে ভারতের সর্বোচ্চ সন্মান “ভারতরত্ন” সন্মানে ভূষিত করলে এবং লাল হেমরমের জীবনীকে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করলে এই মহান মানুষটির প্রতি সঠিক সন্মান প্রদর্শন করা হবে|

Loading