LOADING

মহান শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবি পদ্মশ্রী ডঃ রামদয়াল মুণ্ডা।

Spread the love
ভারতীয় আদিবাসীদের মধ্যে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ডঃ রামদয়াল মুণ্ডাকে বেশীরভাগ ভারতবাসী রাঁচী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর এবং রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য (এমপি) হিসাবেই জানেন। কিন্তু তাঁর ব্যাপক এবং বিশাল কর্মকান্ড তাঁকে একজন মানবদরদী ব্যাক্তি, পিছিয়ে পড়া-সমাজে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অৰ্থনৈতিক উন্নয়নের একজন ব্যস্ততম সৈনিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তিনি আদিবাসী মুণ্ডা সমাজে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কিন্তু তাঁর কর্ম সংস্কৃতির দ্বারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভারতের সম্মান উচু করে গিয়েছেন। সারা জীবন তিনি আদিবাসী তথা সমাজের পিছিয়ে পড়া লোকদের জন্য সংগ্রাম করে গিয়েছেন। মানুষের প্রতি ভালোবাসাই তাঁকে প্রেরণা যুগিয়েছিল মানব সেবায় জীবন উৎসর্গ করতে। রামদয়াল মুণ্ডা ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাঁচী শহরের নিকট অবস্থিত সিউড়ী নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ২৩শে আগষ্ট ১৯৩৯ সালে। তাঁর পিতা ছিলেন গন্দর্ভ সিং মুণ্ডা, মায়ের নাম লোকমা মুন্ডা। প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন তাদের গ্রামের নিকট অমলেশা নামক জায়গায় লুথারেন মিশন স্কুলে। সেই স্কুলে বিদেশ থেকে অতিথিরা আসতেন। আর এভাবে বহির্জগতের সংগে প্রথম থেকেই তাঁর পরিচয় শুরু হয়। ছোটবেলা থেকেই আদিবাসীদের গান, নাচ, বাঁশী বাজানো, মাদল বাজানোর প্রতি তাঁর প্রচন্ড আকর্ষণ ছিল। কিন্তু তাঁর বাবা এসব জিনিস পছন্দ করতেন না। তাঁর ঠাকুর্দা চামু সিং মুন্ডা তাঁকে বাঁশী বাজানো, মাদল বাজানো এবং নাচে গানে প্রশিক্ষিত করেন প্রতিদিন নিকটবর্তী জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে। মাধ্যমিক স্কুল মহকুমার শহর খুঁটিতে পড়াশোনা করেন। সেটা তাঁর গ্রাম থেকে ৪০ কিমি দূরে। বিরসা মুন্ডার আন্দোলনস্থল হওয়ার জন্য বিদেশ থেকে বহু ইতিহাসবিদ ও পর্যটকরা আসতেন সেখানে । ডঃ মুন্ডা তাঁর কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে তাদের গাইড হিসাবে কাজ করতেন। উচ্চশিক্ষার জন্য ডঃ রামদয়াল মুণ্ডা রাঁচী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে নৃতত্ত্ব নিয়ে এম.এ. পাশ করেন ১৯৬৩ সালে। ভাষাতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করার জন্য চিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে (আমেরিকা) সুযোগ পান। ১৯৬৩ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সহকারী গবেষক হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ার ভাষা (অস্ট্রিক সাঁওতাল, কোল, মুণ্ডারি) এবং সভ্যতা নিয়ে গবেষণা করেন এবং ১৯৭০ সালে তিনি সেখান থেকে পিএইচডি পান। তিনি সেই বছরেই আমেরিকার মিনোসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে নিয়োগপত্র পান। ১৯৮৫ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন আর রাচিী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। সেখানে ১৯৮৬ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সহ উপাচার্য আর পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন। তিনি অবসর গ্রহণ করেন ১৯৯৯ সালে। মিনোসোটা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাঁচিী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও তিনি ভিজিটিং প্রফেসর হিসাবে অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৮৩), নিউ ইয়র্কের সিনাকুজ বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯৬) এবং টোকিও ইউনিভাসিটি অফ ফরেন স্টাডিজ এ শিক্ষা দান করেন। কর্মসূত্রে আমেরিকাতে থাকাকালীন তিনি সাংস্কৃতিক দল তৈরী করেন ও আমেরিকার বিভিন্ন শহরে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রচার করনে। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ডঃ রামদয়াল মুণ্ডার অবদানের জন্য ভারত সরকার তাঁকে ২০০৭ সালে সঙ্গীত নাটক একাডেমী পুরস্কার দান করেন। এর কয়েক বছর বাদে ডঃ রামদয়াল মুণ্ডাকে ‘পদ্মশ্ৰী’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এই উপাধি দেশের জনসাধারণকে দেওয়া চতুর্থতম উচ্চ উপাধি যা ডঃ রামদয়াল মুণ্ডাকে রাষ্ট্রপতি ভবনে শ্রীমতি প্রতিভা পাতিল দেন। তাঁর দীর্ঘজীবনে ডঃ রামদয়াল মুণ্ডা দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জড়িত থেকে আদিবাসী তথা দেশের অন্যান্য দেশবাসীর জন্য অনেক কাজ করেছেন। যে সব প্রতিষ্ঠানে তিনি কাজ করেছেন সেগুলি হল – (১) কমিটি অল ঝাড়খন্ড ম্যাটারস (১৯৯৮-১৯৯৫), (২) এনথ্রোপলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (১৯৮৯ -১৯৯৫), (৩) ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসিরিভিউ কমিটি (১৯৯০), (৪) জহরলাল ইউনিভার্সিটি পরিচালন সমিতি (১৯৯০-১৯৯৫), (৫) নর্থ ইস্টার্ন হিল ইউনিভার্সিটি (১৯৯৩-৯৬) ষ্টিয়ারিং প্রপ, (৬) প্ল্যানিং কমিশন (১৯৮৬-২০০০), (৭) এক্সপার্ট কমিটি ন্যাশনাল কমিশন ফর উইমেন (১৯৯৭-২০০০), (৮) ন্যাশনাল এডভাইজারী কমিটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থা (১৯৯৭-২০০০), (৯)স্টাডিং কমিটি হিউম্যান রাইট এডুকেশন – ইউ.জি.সি (১৯৯৮-২০০১), (১০) ন্যাশনাল কমিশন ফর প্রমোশন অফ সোসাল এন্ড ইকোনমিক ওয়েলফেয়ার (১৯৯৮-২০০১), (১১) এক্সপার্ট কমিটি, সাহিত্য একাডেমি (১৯৯৯), (১২)ন্যাসানাল কমিটি ফর টিচার্স এডুকেশন (২০০০-২০০৩), (১৩) চেয়ারম্যান হিসাবে ওয়ার্কিং এপ অন এমপাওয়ারমেন্ট অফ..টি. প্ল্যানিং কমিশন (২০০০-২০০৫), (১৪) টেকনিক্যাল সাপোর্ট গ্রুপ ফর ফরমুলেশন অফ রুলস টু অপারেশনালাইজ দি.এসটি আড আদার ফরেষ্ট ডুয়েলার্স এক্ট (২০০৬-২০০৭), (১৫) কমিটি টু সেট আপ সেন্ট্রাল ট্রাইবাল ইউনিভার্সিটি (২০০৭), (১৬) প্রেসিডেন্ট, আদিম জাতি সেবামণ্ডল (১৯৯০ থেকে), (১৭) প্রেসিডেন্ট, বিনরাই ইনস্টিটিউট অফ রিসার্চ অ্যান্ড আ্যকসন (১৯৯৭ থেকে), (১৮) প্রেসিডেন্ট, অল ইন্ডিয়া লিটারীর ফোরাম (২০০৫), (১৯) সেক্রেটারী-ভারতীয় সাহিত্য বিকাশ ন্যাস (১৯৯৮ থেকে)।   সার্দরি ভাষায় ডঃ রামদয়াল মুণ্ডার স্লোগান ছিল, “যেহে নাচী সেহে বাঁচী‍‌” (যে নাচবে সে বাঁচবে)। নৃত্যই তাঁর কাছে বেঁচে থাকার মন্ত্র। নাচের দ্বারাই তিনি জীবনকে উপভোগ করেছিলেন। ১৯৮৭ সালে রাশিয়াতে যে সাংস্কৃতিক দল পাঠানো হয়েছিল তিনি তার নেতৃত্ব দান করেন। ১৯৮৮ সালে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে, ফিলিপাইনসের ম্যানিলাতে, ১৯৮৯ সালে চীন, জাপান ইত্যাদি দেশে তাঁর সাংস্কৃতিক দল নিয়ে যান। ঝাড়খণ্ডের প্রতিটি গ্রামে যাতে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তথা “আখড়া” তৈরী হয় তিনি তার জন্য অনেক ভাবে চেষ্টা করেন। এছাড়া ডঃ রামদয়াল মুণ্ডা ইন্ডিয়ান কনফেডারেশন অফ ইন্ডিজেনাস অ্যান্ড ট্রাইবাল পিওপলস্ (Confederation of Indigenous & Tribal People) এর একজন প্রতিষ্ঠাতা। জীবিত থাকা অবধি ইনি এই সংস্থার চিফ প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি ভারতীয় আদিবাসীদের প্রতিনিধত্ব করার জন্য জেনিভা (১৯৮৭), কেপেনহ্যাগেন, ডেনমার্ক (১৯৯৭), বার্লিন ভ্রমণ করেন। ভারতবর্ষের আদিবাসীদের নিয়ে ওয়ার্ড সোসাল ফোরাম মুম্বই (২০০৪) এবং নতুন দিল্লী (২০০৭), তিনি তাঁর সাংস্কৃতিক দলের অনুষ্ঠান করেন। ১৯৯৮ সালে নাগপুর ইন্টারন্যাশনাল এলিয়েন্স ফর ইন্ডিজেনাস পিপলস অফ ট্রপিকাল ফরেষ্ট এর অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দেন। ইন্দোরে ১৯৯৯ সালে অনুষ্ঠিত হয় এশিয়ান ইন্ডিজেনাস। পিপলস কনফারেন্স অন ইউনাটেড নেশানস্ পারমানেন্ট ফোরাম অন ইন্ডিজেনাস পিপলস। এই অনুষ্ঠানে তিনি যোগদান করেন। লেখনীতেও তিনি পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। তিনি সর্বমোট ২৮টি বই লিখেছেন। তার মধ্যে কয়েকটি অনুবাদ সাহিত্য। তাঁর লেখা ‘আদিধরম” – ভারতীয় আদিবাসীদের ধর্মীয় বিশ্বাস বহুল প্রচারিত হয়। উল্লেখ্য, তিনি ঝাড়খণ্ড পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান ছিলেন এবং ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠনে তাঁর বিশাল অবদান ছিল। সুত্র – ইন্টারনেট, গুগুল ও অন্যান্য সুত্র।

Loading