গত ২০ শে জুলাই, ২০২৪ পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সদর মেদিনীপুর শহরের মেদিনীপুর মাড়োয়ারী সম্মেলন সভাঘরে অনুষ্ঠিত হল প্রাত্তন বিধায়ক প্রয়াত নরেন হাঁসদার স্মরণ সভা ও দিশম গুরু শিবু সরেন নামাঙ্কিত একটি আশ্রম তৈরীর বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনা সভা| অনুষ্ঠানটির আয়োজক ছিলেন আদিবাসী ডেভেলপমেন্ট ফাণ্ড (Adibasi Development Fund) নামক একটি ট্রাস্ট।
অনুষ্ঠানটি শুরু হয় সকাল ১১ টা নাগাদ ও শেষ হয় বিকেল ৫ টায়। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন আদিবাসী ডেভেলপমেন্ট ফাণ্ড সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মাননীয় প্রদীপ কুমার হাঁসদা মহাশয়।
উদ্বোধনী ভাষণে প্রদীপ কুমার হাঁসদা বলেন যে একসময় পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিন অংশের জঙ্গলমহলে অতি পরিচিত ও জনপ্রিয় নাম ছিলেন প্রয়াত নরেন হাঁসদা।
ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন) দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন নরেন হাঁসদা। বর্তমান ঝাড়গ্রাম জেলার বিনপুর বিধানসভা আসন থেকে ২বার বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন। তৎকালীন সময়ে জঙ্গলমহল জুড়ে ঝাড়খণ্ড আন্দোলন সংগঠিত করার মাধ্যমে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে এসেছিলেন প্রয়াত নরেন হাঁসদা।
তবে নরেন হাঁসদা শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না। আদিবাসী সমাজের সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও নরেন হাঁসদার অবদান অপরিসীম। প্রদীপ বাবু অভিযোগ করেন অনেক আদিবাসী সামাজিক সংগঠন ও লেখকেরা সামাজিক ক্ষেত্রে নরেন হাঁসদার অবদানের কথা প্রচার করেনি যার ফলে বর্তমান প্রজন্ম নরেন হাঁসদাকে শুধুমাত্র একজন রাজনিতিক হিসেবেই চেনে।
নরেন হাঁসদার নিজের হাতে প্রতিস্থিত রাজনৈতিক দল ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন) বর্তমানে অস্তিত্বহীন তাই তাদের পক্ষে নরেন হাঁসদার স্মরণ সভা আয়োজন করা সম্ভব হয় না। আবার আদিবাসী সামাজিক সংগঠনগুলিও নরেন হাঁসদাকে শুধুমাত্র রাজনিতিক হিসেবেই দেগে দিয়েছে তাই তারাও নরেন হাঁসদার স্মরণ সভা আয়োজন করে না।
তাই সামাজিক ক্ষেত্রে নরেন হাঁসদার অবদানকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে ও সামাজিক সংগঠন, লেখকদের জ্ঞানচক্ষু খুলে দিতে আদিবাসী ডেভেলপমেন্ট ফাণ্ড (Adibasi Development Fund) নরেন হাঁসদার এই স্মরণ সভার আয়োজন করেছে। প্রদীপ বাবু এই আশাও করেন যে এই অনুষ্ঠান সফল ভাবে আয়োজন করার পর আগামী দিনে আদিবাসী সামাজিক সংগঠন ও লেখকেরাও নিয়মিত ভাবে নরেন হাঁসদার স্মরণ সভা আয়োজন করবেন।
সভায় সব বক্তায় প্রয়াত নরেন হাঁসদাকে পরম শ্রদ্ধার সাথে স্মরন করেন ও ওনার জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন ও দিশম গুরু শিবু সরেন নামাঙ্কিত আশ্রম তৈরির প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। সকল বক্তাদের আলোচনা থেকে জানা যায় যে নরেন হাঁসদা ১৯৫৫ সালের ১৪ ই ডিসেম্বর জন্মগ্রহন করেন বর্তমান ঝাড়গ্রাম জেলার বিনপুর বিধানসভা এলাকার মাগুরা গ্রামে। ১৯৯৯ সালের ২৫ শে জুন এই মহান আদিবাসী-ঝাড়খণ্ডী নেতার মৃত্যু হয়|
বিনপুর বিধানসভা আসন থেকে দুইবার বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন| প্রথম রাজনৈতিক জীবনে ঝাড়খণ্ড পার্টির সদস্য থাকলেও পরবর্তীকালে দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি এন ই হোরো মহাশয়ের সাথে মতবিরোধের কারণে ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন) দলের প্রতিষ্ঠা করেন ও প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হোন|
১৯৭৭ সালে ঝাড়গ্রামের বেতকুন্দরি মাঠে সারা ভারত আদিবাসী সাঁওতাল সম্মেলন আয়োজন ও সেই সম্মেলনে পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু ও দিশম গুরু শিবু সরেনকে নিয়ে আসার ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন| আদিবাসী সাঁওতালদের সামাজিক সংগঠন ভারত জাকাত মাঝি মাডোয়ার সাংগঠনিক বিস্তারে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন| নরেন হাঁসদা প্রথমবার বিধানসভায় নির্বাচিত হয়ে সাঁওতালি ভাষায় শপথ গ্রহণ করে ইতিহাস রচনা করেছিলেন। এই মহান আদিবাসী-ঝাড়খণ্ডী নেতার মৃত্যুতে পশ্চিবঙ্গের আদিবাসী-মূলবাসী-ঝাড়খণ্ডী সমাজের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অপূরনীয় ক্ষতি হয়েছে| অথচ এই মহান নেতার অবদানকে সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরার প্রয়াস সেই ভাবে লক্ষ্য করা যায় না|
নরেন হাঁসদার স্মরণ সভা সম্পন্ন করার সাথে সাথে আরেক কিংবদন্তী আদিবাসী-ঝাড়খণ্ডী নেতা দিশম গুরু শিবু সরেন নামাঙ্কিত একটি আশ্রম নির্মাণের বিষয়েও আলোচনা করা হয়। প্রদীপ বাবু জানান যে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রবেশ করার আগে দিশম গুরু শিবু সরেন সামাজিক আন্দোলন চালিয়েছিলেন। সামাজিক আন্দোলন সংগঠিত করার বীজ বপন করা হয়েছিল বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের ধানবাদ জেলার টুণ্ডি ব্লকের পোখরিয়া গ্রামে।
এই পোখরিয়া গ্রামে থাকতেন দিশম গুরু শিবু সরেনের সাথী শ্যামলাল মুরমু। সেই সময় “ধান কাটো” আন্দোলন চালাচ্ছিলেন দিশম গুরু শিবু সরেন। সুদখোর মহাজনেরা সুদের ফাঁদে ফেলে আদিবাসীদের সব জমি জায়গা দখল করে চাষ শুরু করেছিল। সেই দখলীকৃত জমির ধান পেকে গেলে শিবু সরেন আর তাঁর দলবল সেই জমির ধান জোর করে কেটে নিয়ে আসত। জমির ধান তিন ভাগে ভাগ করা হত। জমির আসল মালিক এক ভাগ পেতেন, যারা জমির ধান কাটতে সাহায্য করত তারা পেত দ্বিতীয় ভাগ আর তৃতীয় ভাগ আপতকালিন সময়ের জন্য জমা থাকত। কিন্তু সমস্যা হল এই তৃতীয় ভাগ ধান কোথায় রাখা হবে? তখনেই শিবু সরেনের মাথায় একটি আশ্রম নির্মাণের কথা মাথায় আসে। সেই মতন পোখরিয়া গ্রামে তৈরি হয় আশ্রম পরবর্তীকালে যা শিবু আশ্রম নামে পরিচিত হয়।
এই আশ্রমের দেখাশোনা করতেন শ্যামলাল মুরমু ও তাঁর মাতা। প্রতিদিন শয়ে শয়ে মানুষ এই আশ্রমে আসতেন, তাদের দেখাশোনা করা ও খাবারের আয়োজন সমেত সমস্ত বিষয় দেখাশোনা করতেন শ্যামলাল মুরমু ও তাঁর মাতা। পরবর্তীকালে দিশম গুরু রাজনিতিতে প্রবেশ করে সাঁওতাল পরগণা ডিভিশনে চলে গেলে উগ্রপন্থীরা এই আশ্রমে বোমা দিয়ে হামলা চালালে শ্যামলাল মুরমু মারা যান। এই আশ্রম থেকেই শিবু সরেন তাঁর সামাজিক আন্দোলন চালিয়েছিলেন। গ্রামবাসীদের শিক্ষিত করতে রাত্রিকালীন স্কুল চালু হয়েছিল, আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ ও পশুপালন করতে গ্রামবাসীদের প্রশিক্ষণ দিতেন শিবু ও তাঁর সাথিরা। মদ-হাঁড়িয়া এর মতন নেশাদ্রব্য থেকে দূর থাকতে ও নেশামুক্ত সমাজ গড়তে যে আন্দোলন চালিয়েছিলেন শিবু সরেন ও তাঁর সাথীরা তারও সাক্ষী এই পোখরিয়া আশ্রম। সুদখোর মহাজনদের বিরুদ্ধে যে বিখ্যাত আন্দোলন চালিয়েছিলেন তারও রূপরেখা এই পোখরিয়া আশ্রমেই হয়েছিল। শিবু সরেন থেকে দিশম গুরু হয়ে ওঠার পথে অন্যতম ধাপ এই পোখরিয়া আশ্রম। দিশম গুরু শিবু সরেন স্থাপিত আশ্রম থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েই পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহল এলাকায় একটি আশ্রম নির্মাণের স্বপ্ন অনেকদিন ধরে দেখছিলাম। বিষয়টি নিয়ে পরিচিত অনেকজনের সাথে আলোচনা হয়েছিল। প্রায় সবাই উৎসাহ দিয়েছেন। সেই মোতাবেক দিশম গুরু শিবু সরেনের নামেই একটি আশ্রম নির্মাণের বিষয়টি ঠিক হয়েছে। এই আশ্রমে অনাথ, দুঃস্থ শিশু, বাচ্চা ও বয়স্ক বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের রাখার চিন্তাভাবনা আছে। এই আশ্রম নির্মাণের বিষয়টি নিয়েও প্রাথমিক আলোচনা সম্পন্ন হল।
এই দিনের অনুষ্ঠানে উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ও বক্তব্য রেখেছেন প্রদীপ কুমার হাঁসদা, বিপ্লব হেমরম, শতদল মাণ্ডি, সুশান্ত দলুই, সনাতন টুডু, চরন মুরমু ও শেখ সরতাজউদ্দিন মহাশয়। আদিবাসী ডেভেলপমেন্ট ফাণ্ড এর পক্ষ থেকে সকল বক্তা ও উপস্থিত মানুষদের ধন্যবাদ জানানো হয়।
অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ভাষণে প্রদীপ বাবু জানান যে Adibasi Development Fund সংস্থাটি একটি ট্রাস্ট হিসেবে রেজিস্টার করা হয়েছে। বর্তমানে Adibasi Development Fund সংস্থাটি Income Tax আইনের 80G ধারা অনুসারেও রেজিস্টার্ড, যার কারণে যে বা যারা Adibasi Development Fund সংস্থাকে টাকা দান করবেন তার আইন অনুসারেই Income Tax ছাড় পাবেন| তাই যে সমস্ত মানুষ ইতিমধ্যে Income tax এর আওতায় পড়েছেন এবং নিয়ম করে প্রতিবছর Income tax দিচ্ছেন তাদের অনুরোধ করব যে আপনারা আপনাদের ইচ্ছে/সাধ্য মতন টাকা Adibasi Development Fund সংস্থাকে দান করুন ও Income tax ছাড় পান এবং এই সংস্থাকেও মানুষকে সেবা করার সুযোগ দিন| টাকা দান করার জন্য Adibasi Development Fund এর Bank details সর্বসাধারণকে জানানো হল।
Accout Name: Adibasi Development Fund, Bank Account No: 0183200100019447, IFSC Code PUNB0018320, Punjab National Bank Jhargram Branch.
সেই সঙ্গে প্রদীপ বাবু এটাও জানান যে টাকা দান করলে অতি অবশ্যই রসিদ সংগ্রহ করবেন| Adibasi Development Fund বিষয়ে কারোর কোনো কিছু জানার থাকলে যোগাযোগ করবেন – Pradip Kumar Hansda (Mob & WhatsApp 7278587028).