লিখেছেন – প্রদীপ কুমার হাঁসদা|
একসময় এই পশ্চিমবাংলার আদিবাসী অধ্যুষিত জঙ্গলমহল এলাকা তথা অবিভক্ত মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান ও হুগলী জেলার একাংশে তুমুল ঝাড়খণ্ড আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল| সেই সময় অনেক ঝাড়খণ্ডি নেতা কর্মীগণ আত্মবলিদান দিয়েছিলেন| অনেক ঝাড়খণ্ডি নেতা কর্মীগণ দুর্দান্ত নেতৃত্ব পরিচালনার দক্ষতা দেখিয়েছিলেন| কিন্তু দুঃখের কথা সেই সমস্ত দুর্দান্ত ইতিহাস আজ অনেকেরই অজানা| কিন্তু ইতিহাস হল এমন এক আয়না যার মাধ্যমে মানুষ নিজের বর্তমানকে বুঝতে পারে| যে সমাজ নিজের ইতিহাস জানে না, সে কোনদিনেই বর্তমানে অন্যদের থেকে এগোতে পারে না, নিজের ভালমন্দ বুঝতে পারে না, নিজের শত্রু মিত্র চিনতে পারে না| তাই নিজ সমাজের ইতিহাস আমাদের সকলেরই জানা উচিৎ|
ঝাড়খণ্ড আন্দোলন আদিবাসী সমাজের আত্মপরিচিতিকে সামনে নিয়ে এসেছে, অন্যদের বাধ্য করেছে আদিবাসী সমাজকে গুরুত্ব দিতে| এইখানেই ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের সার্থকতা|
পশ্চিমবাংলায় ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের ইতিহাস সেইভাবে লেখা হয়নি| যে সামান্য লেখালেখি পাওয়া যায়, সেইগুলি প্রায় সবগুলি ইংরেজিতে লেখা| বাংলা ভাষায় ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের ইতিহাস প্রায় দুপ্রাপ্য| তাই ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের নায়কদের কথা বর্তমান প্রজন্ম প্রায় জানে না| আমরা যারা সামান্য লেখাপড়া শিখেছি, আমাদেরই উচিৎ এই সব ইতিহাস লেখা, ইতিহাসের উপেক্ষিত নায়কদের কথা বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা| পুরোনে দিনের একসময়ের দুর্ধর্ষ ঝাড়খণ্ডী নেতা শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশায় প্রাণকৃষ্ণ টুডুর কথা আজ এই লেখার মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করছি|
অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার ঝাড়খণ্ড আন্দোলনকারীদের মধ্যে অন্যতম প্রাণকৃষ্ণ টুডু| খুব অল্প বয়সে প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি পান প্রাণকৃষ্ণ টুডু| ছোট থেকেই নিজের সমাজের প্রতি কিছু করার তাগিদ ছিল শিক্ষক প্রাণকৃষ্ণ টুডুর|
সেই সময় পশ্চিমবাংলায় সদ্য সদ্যই ঝাড়খণ্ড আন্দোলন শুরু হয়েছে| সম্ভবত ১৯৬৪-৬৫ সাল নাগাদ বর্তমান ঝাড়গ্রাম জেলার রানারাণি গ্রামে ঝাড়খণ্ড পার্টির পশ্চিমবাংলা রাজ্য শাখা তৈরি হয়েছে| মূখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন শ্যামচরন মুর্মু| প্রথম দিকে ঝাড়খণ্ড পার্টির কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ভীমপুর এলাকা| এরপর ঝাড়খণ্ড পার্টিতে রাজ্য সভাপতি করা হয় দাক্ষিণ মুর্মুকে| ঝাড়খণ্ড পার্টির কেন্দ্রবিন্দু স্থানান্তরিত হয় লালগড়ে| তুমুল আন্দোলন শুরু করে ঝাড়খণ্ড পার্টি| দাক্ষিণ মুর্মুকে নিজের গুরু মনে করতেন প্রাণকৃষ্ণ টুডু| মেদিনীপুর জেলার বুগড়ি এলাকায় সক্রিয়তা ছিল প্রাণকৃষ্ণ টুডুর| মূলত সংগঠক ছিলেন| আন্দ়োলন পরিচালনা ও সংগঠন বিস্তার করতেন প্রাণকৃষ্ণ টুডু| ঝাড়খণ্ড পার্টির সভা সমাবেশে খুব কম বক্তব্য পেশ করতেন| দলের প্রয়োজনে ও বিভিন্ন মামলা মোকর্দমার সূত্রে মেদিনীপুর শহরে আসতেন, উকিলদের সাথে দেখা করতেন, তাই আইনি ও প্রশাসনিক দিকটি খুব ভাল বুঝতেন| প্রাণকৃষ্ণ টুডু মহাশয়ের এই আইনি ও প্রশাসনিক বিষয়ে দক্ষতাকে খুব কাজে লাগিয়েছিল ঝাড়খণ্ড পার্টির নেতৃত্ব| সেই সময় অনেক শিক্ষক ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন| তৎকালীন শাসকদলের সমর্থকেরা ঝাড়খণ্ড পার্টি সমর্থক শিক্ষকদের বিভিন্ন ভাবে হেনস্থা করত, স্কুলে ঢুকতে দিত না বা বেতন আটকানোর চেষ্টা করত| এই সব সমস্যার সমাধান করতেন প্রাণকৃষ্ণ টুডু| কখনও নিজে স্কুলগুলিতে গিয়ে ঝাড়খণ্ড পার্টি সমর্থক শিক্ষকদের কাজে যোগদান করাতেন বা কখনও উকিলের মাধ্যমে আইনের সাহায্য নিতেন|
১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর “অপারেশন বর্গা” চালু করে| এই “অপারেশন বর্গা”-র মাধ্যমে জোতদার জমিদারদের বাড়তি জমি খাস ঘোষনা করে ভূমিহীনদের মধ্যে বিলিয়ে দেবার পরিকল্পনা করে বামফ্রন্ট সরকার| এই পরিকল্পনার আড়ালে অনেক বিরোধী পরিবারকে টাইট বা সর্বশান্ত করার পরিকল্পনা করেছিল তৎকালীন শাসকদলের স্থানীয় নেতৃত্ব| যে সমস্ত পরিবার তৎকালীন শাসকদলের কাছে আত্মসমর্পণ করত না তাদের সমস্ত জমি বেআইনি ভাবে খাস ঘোষনা করে নিজ দলের অনুগামীদের মধ্যে বিলি করত তৎকালীন শাসকদের স্থানীয় নেতৃত্ব| এই ক্ষতিগ্রস্ত বা সর্বশান্ত পরিবারগুলির মধ্যে অনেকগুলি আদিবাসী পরিবারও ছিল| ঝাড়খণ্ড পার্টি এই ক্ষতিগ্রস্ত বা সর্বশান্ত পরিবারগুলির পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তৎকালীন শাসকদলের সমর্থকদের সাথে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়| শাসকদলের রোষানলে পড়ে ঝাড়খণ্ড পার্টি সমর্থকদের কত যে গ্রাম লুট হয়েছে, আগুনে পুড়েছে তার হিসেব নেই| অভিযোগ সেই সময় ঝাড়খণ্ড পার্টির সমর্থকদের লড়াই করতে হয়েছে শাসকদলের সমর্থকদের পাশাপাশি অধিকাংশ পুলিস প্রশাসনদেরও সাথে| তখন ঝাড়খণ্ড পার্টির সমর্থকদের ভরসা প্রাণকৃষ্ণ টুডুর মতন শুধুমাত্র হাতে গোনা কয়েকজন লড়াকু নেতা, যাদের অনমনীয় মনোভাব তৎকালীন শাসকদলের নেতাদের শান্তিতে থাকতে দেয়নি| তাই পুলিসকে কঠোর নির্দেশ দেওয়া ছিল যেকোনো ভাবেই প্রাণকৃষ্ণ টুডু ও তার সঙ্গী সাথীদের গ্রেফতার করার| তবে হাজার চেষ্টা করেও প্রাণকৃষ্ণ টুডুকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিস|
১৯৭১ ও ১৯৭২ সালে দুইবার ঝাড়খণ্ড পার্টির পক্ষ থেকে গড়বেতা (পশ্চিম) বিধানসভা আসনে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন| নিজের রাজনৈতিক জীবনে কাজ করেছেন প্রয়াত নরেন হাঁসদা, শিবু সরেন, মনোরঞ্জন মাহাত, দাক্ষিণ মুর্মু, প্রয়াত চিত্ত মান্ডি দের মতন ঝাড়খণ্ডী নেতাদের সাথে| দাক্ষিণ মুর্মু ঝাড়খণ্ড পার্টি ত্যাগ করার পরেও ঝাড়খণ্ড পার্টিতেই ছিলেন প্রাণকৃষ্ণ টুডু| পরে ঝাড়খণ্ড পার্টি ভাগ হয়ে ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন) তৈরী হবার সময় ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন) দলেই ছিলেন প্রাণকৃষ্ণ টুডু| পরবর্তীকালে নরেন হাঁসদার সাথে মতবিরোধের জেরে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা (জেএমএম) দলে যোগ দেন এবং পরবর্তীকালে আর দল বদল করেননি| ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা সুপ্রিমো দিশম গুরু শিবু সরেনকে আগে থেকেই চিনতেন| প্রাণকৃষ্ণ টুডু মহাশয় ঝাড়খণ্ড পার্টিতে থাকাকালীনই একবার দিশম গুরু শিবু সরেন গোয়ালতোড়, হুমগড় এলাকায় প্রচারে এসেছিলেন| সেই সময় নাকি প্রাণকৃষ্ণ টুডুর বাড়ি (টাঙ্গাশোল) তেও গিয়েছিলেন| রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলনেও সমান সক্রিয় ছিলেন প্রাণকৃষ্ণ টুডু| সাঁওতালী ভাষার লিপি “অলচিকি” প্রচারে সক্রিয় ছিলেন| এলাকায় ASECA ও অলচিকির প্রচার প্রসারে উদ্যোগ নিয়েছিলেন|
ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের গর্ভে অনেক প্রাণকৃষ্ণ টুডু রয়েছেন যারা আজ বর্তমান প্রজন্মের কাছে অচেনা অজানা| প্রাণকৃষ্ণ টুডুর মতন মানুষেরা সারা জীবন শুধু সমাজকে দিয়ে গিয়েছেন, বিনিময়ে কিছু পাননি| যে ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠনের স্বপ্ন নিয়ে তরুন বয়সে প্রাণকৃষ্ণ টুডুর মতন অসংখ্য মানুষ নিজেদের ভবিষ্যতের কথা না ভেবে শুধু সমাজের কথা ভেবে এগিয়ে এসেছেন তাঁদের যথাযথ সন্মান জানানোর সময় এসেছে| আজ ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠিত হয়েছে| বর্তমানে ঝাড়খণ্ড রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছে ঝাড়খণ্ড রাজ্য আন্দোলনকারী দল ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা (জেএমএম)| ঝাড়খণ্ড রাজ্য আন্দোলনকারীদের চিহ্নিত করে সন্মান ও পেনশনের ব্যাবস্থা করুক ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা (জেএমএম) নেতৃত্বাধীন ঝাড়খণ্ড রাজ্য সরকার| এটাই হবে প্রাণকৃষ্ণ টুডুর মতন মানুষ, যারা সারা জীবন শুধু সমাজকে দিয়ে গিয়েছেন, বিনিময়ে কিছু পাননি, তাদের প্রতি যথাযথ সন্মান প্রদর্শন|