লিখেছেন – প্রদীপ কুমার হাঁসদা।
ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের মহান নেতা দিশম গুরু শিবু সরেনের জন্ম ১৯৪৪ সালের ১১ ই জানুয়ারি তৎকালীন বিহার রাজ্যের হাজারীবাগ জেলার (বর্তমানে রামগড় জেলা) নেমরা গ্রামে হয় । পিতা শোবরান সরেন গ্রামের শিক্ষক ছিলেন । শোবরান সমাজ সচেতন শিক্ষক ছিলেন। আদিবাসীদের বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন করতেন ওসুদখোর মহাজনদের থেকে দূরে থাকতে বলতেন । ওইসময় সুদখোর মহাজনরা গরীব আদিবাসীদের ঋণ দিয়ে মোটা টাকা সুদ আদায় করত । সুদ দিতে গিয়ে আদিবাসীরা তাদের সারা বছরের চাষ করা ধান মহাজনদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হত । শোবরান আদিবাসী গ্রামবাসীদের বোঝাতেন যে কোন অবস্থাতেই সুদখোর মহাজনদের কাছে থেকে ঋণ নেওয়া যাবে না আর সুদখোর মহাজনদের গ্রামে প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না । শোবরান সরেনের জন্য সুদখোর মহাজনেরা আদিবাসী গ্রামবাসীদের শোষণ করতে পারছিলনা, তাই তারা শোবরান সরেনকে খুন করার পরিকল্পনা করে । ২৭ নভেম্বর ১৯৫৭ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে শিবু সরেন তার পিতা কে সুদ খোর মহাজনদের গুণ্ডাদের হাতে খুন হতে দেখেন । শিবু সরেন তখন ক্লাস নাইন এর ছাত্র ।
শিবু সরেনরা পাঁচ ভাই ছিলেন । শিবু সরেন ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান । পিতার হত্যা বালক শিবুকে উগ্র করেতোলে কিন্তু শিবুর মা তাকে প্রতিশোধের পথে না হেঁটে মানুষের মত মানুষ তৈরি হতে পড়াশোনা করতে বলে । বালক শিবু মাধ্যমিক পাশ করেন কিন্তু সুদখোর মহাজনদের প্রতি তাঁর ক্ষোভ থেকেই যায় । তরুন শিবু উপলব্ধি করেন যে আদিবাসী সমাজে অত্যাধিক নেশা ও শিক্ষার অভাবই সুদখোর মহাজনদের আদিবাসী গ্রামগুলিতে টেনে আনছে । তাই আদিবাসী যুবকদের মধ্যে নেশাবিরোধী সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য ১৯৬২ সালেমাত্র ১৮ বছর বয়সে শিবু সরেন গঠন করেন “সাঁওতাল নবযুবক সংঘ” এবং আদিবাসী যুবকদের নেশাবিরোধী আন্দোলনে সামিল করেন । সুদখোর মহাজনেরা ঋণের ফাঁদে ফেলে এলাকার বেশীরভাগ আদিবাসী ও গরীব মানুষদেরজমি দখল করে নিয়েছিল। তরুন শিবু বুঝতে পারছিলেন যে শুধু নেশাবিরোধী আন্দোলন চালালে হবে না, আদিবাসী ও গরীব মানুষদের জমিও উদ্ধার করে দিতে হবে, আর তাঁর জন্য চাই শক্তিশালী সংগঠন । শক্ত সাংগঠনিক ভিত যুক্ত সংগঠন গড়ে তুলতে ১৯৬৯ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে শিবু সরেন গঠন করেন “সনত সাঁওতাল সমাজ” এবং ধানবাদ জেলার তুন্ডি ব্লকে গড়ে তোলেন আশ্রম । তুন্ডির আশ্রম স্থাপন করে শিবু সরেন “ধান কাটো” ও “জমি উদ্ধার” আন্দোলনের ডাক দেন । যে সমস্ত আদিবাসীদের জমি সুদখোর মহাজনেরা দখল করে নিয়েছিল, শিবু সরেনের নেতৃত্বে আদিবাসীরা সেই সব জমির ধান জোর করে কেটে নিতেন ও জমির দখল নিতেন । সুদখোর মহাজনদের বিরুদ্ধে আদিবাসী ও সাধারন গরীব মানুষদের নিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন শিবু সরেন । শিবু সরেনের নেতৃত্বে এই “ধান কাটো” ও “জমি উদ্ধার” আন্দোলন সুদখোর মহাজনদের বিরুদ্ধে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রুপান্তরিত হয় । তুন্ডির আশ্রম গড়ে তোলার পর থেকে উল্কার গতিতে শিবু সরেনের উত্থান ঘটে। আসে পাশের জেলাগুলিতে শিবু সরেনের নাম ও আন্দোলনের খবর ছড়িয়ে পড়ে । সুদখোর মহাজনদের জালে জড়িয়ে সর্বস্ব হারানো ও নিজ জমি থেকে বেদখল হওয়া আদিবাসী ও সাধারন আদিবাসীরা দলে দলে শিবু সরেনের দলে নাম লেখান । শিবু সরেন তাদের কাছে সাক্ষাৎ ভগবান রুপে দেখা দেন । শিক্ষক শোবরান সরেনের ছেলে শিবু সরেন আদিবাসী ও সাধারন মানুষদের কাছে পরিচিত হন “গুরুজি” নামে । সুদখোর মহাজনেরাও চুপ করে বসেছিল না, তারাও পাল্টা প্রত্যাঘাত হানতে শুরু করল । সুদখোর মহাজনেরা সঙ্গে নিল দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিস প্রশাসনকে । শিবু সরেনের সঙ্গীদের ওপর সুদখোর মহাজনদের ভাড়া করা গুণ্ডারা প্রাণঘাতী হামলা শুরু করল, শিবু সরেনের আশ্রমগুলির ওপরেও হামলা হয় । প্রচুর মামলা শিবু সরেন ও তাঁর সাথীদের বিরুদ্ধে দায়ের হয়, পুলিস শিবু সরেন ও তাঁর সাথীদের খুঁজতে থাকে,অনেকেই পুলিসের হাতে ধরা পড়েন বা গুলিতে মারা যান, কেও কেও সুদখোর মহাজনদের ভাড়া করা গুণ্ডাদেরও হাতে মারা যান, কিন্তু সবার ধরা ছোঁওয়ার বাইরে থাকেন শিবু সরেন । ততদিনে শিবু সরেন পরিচিত হতে শুরু করেছেন “দিশম গুরু” নামে মানে দেশের নেতা হিসেবে । আন্দোলন থেমে থাকেনি, দিনে দিনে আরও জোরদার হয়েছে আর দিকে দিকে দিশম গুরু শিবু সরেনের নাম আগুনের মত ছড়িয়ে পড়তে লাগল । পুলিস যখন হন্য হয়ে দিশম গুরু শিবু সরেনকে খুঁজতে শুরু করেছে তখন শিবু সরেন আশ্রয় নিয়েছেন পরেশনাথ পাহাড়ের জঙ্গলে । পরেশনাথ পাহাড়ে রীতিমত দিশম গুরু শিবু সরেন সমান্তরাল সরকার গঠন করে ফেলেছেন । জঙ্গল থেকেই দিশম গুরু শিবু সরেন তাঁর আন্দোলন পরিচালনা করছেন । দিশম গুরু শিবু সরেনের এখন অনেক অনুগামী। পাহাড় জঙ্গল ছাড়িয়ে শহর ও শিল্পাঞ্চলেও দিশম গুরু শিবু সরেনের নাম ও অনুগামী তৈরি হয়ে গেছে । পুলিস প্রশাসনও জোরদার দমন পীড়ন শুরু করেছে । দিশম গুরু শিবু সরেন ও তাঁর অনুগামিদের ধরতে স্পেশাল পুলিস টিমও তৈরি করা হয়েছে । কিন্তু দিশম গুরু শিবু সরেনকে কিছুতেই ধরতে পারছেনা পুলিস । শোনা যায় নাকি একসময় দিশম গুরু শিবু সরেনকে এনকাউন্টার করে মেরে ফেরাও ছক কষা হয়েছিল । কিন্তু সবচেষ্টা বিফলে যেতে লাগল । পুলিস গাদা গাদা মামলা দিশম গুরু শিবু সরেন ও তাঁর অনুগামীদের নামে দায়ের করতে লাগল ।
১৯৭১ সালের দিকে ৫০ বছর বয়সী বিনোদ বিহারী মাহাতোর সাথে এক মামলার সুত্র ধরে পরিচয় ঘটে ২৭ বছর বয়সী তরুন যুবক শিবু সরেন । মামলা তদারকি করতে গিয়ে দিশম গুরু শিবু সরেন খোঁজ পান বিনোদ বিহারী মাহাতোর । বিনোদ বাবু উকিল ছিলেন এবং আদিবাসী ও গরীব মানুষদের মামলা বিনা পয়সায় লড়তেন । ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি নাগাদ দিশম গুরু শিবু সরেন বিনোদ বিহারী মাহাতোর সাথে দেখা করেন । জানা যায় যে বিনোদ বিহারী বাবুও সংগ্রামী মানুষ, গঠন করেছেন শিবাজী সমাজ ও সমাজের বিভিন্ন কুরীতি, সুদখোরী, মহাজনী ও সামন্ত প্রথার শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তুলছেন । দিশম গুরু শিবু সরেন বুঝতে পারছিলেন যে আইনি বিষয় ও মামলা মোকদ্ধমা বিষয়ে বিনোদ বাবু তাকে সাহায্য করতে পারবেন আর তাই বিনোদ বাবুকে একসাথে আন্দোলন করার প্রস্তাব দিলেন । অভিজ্ঞ বিনোদ বিহারী মাহাতো সঙ্গে সঙ্গে দিশমগুরুর প্রস্তাবে সম্মতি জানালেন এবং সেই সঙ্গে শ্রমিক ইউনিয়ন নেতা অরুন কুমার রায় (এ কে রায়) এর ব্যপারে দিশম গুরু শিবু সরেনকে জানালেন এবং তাকেও সঙ্গে নেওয়ার প্রস্তাব দিলেন ।
বিনোদ বিহারী মাহাতোর জন্ম ২৩ ই সেপ্টেম্বর ১৯২১ সালে বালিয়াপুর জেলার বড়াদাহা গ্রামে এক গরিব পরিবারে হয় । পিতার নাম মাহিন্দি মাহাত ও মাতার নাম মন্দাকিনী দেবী । বিনোদ বাবু প্রথমে করণিকের কাজ করতেন কিন্তু একবার উকিল দ্বারা অপমানিত হওয়ার পর উকিল হবার প্রতিজ্ঞা নেন ও পরবর্তীকালে ১৯৫৬ সালে আইন পাস করে উকিল হন । উকিল হিসেবে বিনোদ বাবু গরিব মানুষদের বিনা পয়সায় মামলা লড়তেন । ১৯৬৪ সাল নাগাদ ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) তথা CPI(M) এর সঙ্গে যুক্ত হন । ৬ই এপ্রিল, ১৯৬৯ সাল নাগাদ সমাজের বিভিন্ন কুরীতির সঙ্গে লড়াই করতে গঠন করেন শিবাজী সমাজ । শিবাজীসমাজের অধীনে বিনোদ বিহারী বাবু সুদখোরি, মহাজনী প্রথা, সামন্ত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন । ১৯৬৭ ও ১৯৭১ সালের নির্বাচনে সিপিআই(এম) পার্টির হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন কিন্তু হেরে যান । পরবর্তীকালে সিপিআই (এম) দলের উচ্চ নেতৃত্বের সাথে মত বিরোধের কারনে সিপিআই (এম) দল ত্যাগ করেন ।
১৯৬৫ সাল পরবর্তীকালে তরুন বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার অরুন কুমার রায় বা এ কে রায় ধানবাদ জেলার সিন্ধ্রিসার কারখানায় চাকরি করতে আসেন । কিন্তু অচিরেই স্থানীয় আদিবাসী ও মুলবাসি শ্রমিকদের ওপর কয়লা মাফিয়া, সুদখোর মহাজন, কারখান কতৃপক্ষের জুলুম ও অত্যাচার দেখে চাকরি তে ইস্তফা দিয়ে গড়ে তোলেন “বিহার কোলিয়ারি শ্রমিক ইউনিয়ন” এবং শ্রমিকদের পাশে দাড়িয়ে কয়লা মাফিয়া, সুদখোর মহাজন, কারখান কতৃপক্ষের জুলুম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করেন । অরুন বাবু সিপিআই(এম) দলেরও সদস্য ছিলেন কিন্তু মতবিরোধের কারনে সিপিআই(এম) দল থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন । অরুন বাবুও নিজস্ব সংগঠন মার্ক্সবাদী সমন্বয় সমিতি (Marxists Cordination Committee) গঠন করেছিলেন ।
সিপিআই(এম) দলের সদস্য থাকা কালীন বিনোদ বিহারী মাহাতোর সাথে অরুন কুমার রায়ের পরিচয় ছিল । তাই দিশম গুরু শিবু সরেন যখন বিনোদ বিহারী মাহাতোকে এক সঙ্গে আন্দোলনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তখন অরুনকুমার রায়কেও সাথে নেবার কথা দিশম গুরু শিবু সরেনকে জানান । তাতে সম্মতি জানিয়ে এক মিটিং এর আয়োজন করার দায়িত্ব বিনোদ বিহারী মাহাতো কেই দেন দিশম গুরু শিবু সরেন ।
৪ ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২ সালে ঐতিহাসিক মিটিং হয় তিন দিকপাল নেতা দিশম গুরু শিবু সরেন, বিনোদ বিহারীমাহাতো ও অরুন কুমার রায়ের । মিটিং হয় বিনোদ বিহারী মাহাতোর ঘরে । ঠিক হয় শিবাজী সমাজ, সনত সাঁওতাল সমাজ ও মার্ক্সবাদী কোঅরডিনেশেন কমিটিকে মিলিয়ে দিয়ে এক যৌথ সংগঠন গড়ে তোলা হবে । সেই সময় বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধে মুক্তি যোদ্ধাদের সংগ্রাম ভারতেও জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল । বাংলাদেশের মুক্তি যোদ্ধাদের আদলে ঠিক হয় নতুন সংগঠনের নাম হবে “ঝাড়খণ্ড লিবারেশেন ফ্রন্ট – Jharkhand Liberation Front”। কিন্তু গ্রামীণ আদিবাসী ও সাধারন মানুষদের কাছে “ঝাড়খণ্ড লিবারেশেন ফ্রন্ট – Jharkhand Liberation Front” উচ্চারণকরতে বা বুঝতে অসুবিধা হতো তাই অচিরেই “ঝাড়খণ্ড লিবারেশেন ফ্রন্ট – Jharkhand Liberation Front” সাধারন মানুষের মুখে মুখে জনপ্রিয় হল “ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা- Jharkhand Mukti Morcha (JMM)” রুপে । ঠিক এক বছর বাদে ৪ ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৩ সালে ধানবাদে এক বিশাল জনসমাবেশ করে আনুষ্ঠানিক ভাবে আত্মপ্রকাশ করে “ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা”। বয়স ও অভিজ্ঞতার কারনে সভাপতি নির্বাচিত হন বিনোদ বিহারী মাহাত, সব থেকে জনপ্রিয়তম মুখ হিসেবে সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন দিশম গুরু শিবু সরেন । ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা গঠিত হবার পর পৃথক ঝাড়খণ্ড আন্দোলন তাঁর সময়কালে তীব্রতম গতি লাভ করে।
(ক্রমশ…..)