লিখেছেন – তপন কুমার সরদার (শিক্ষক)।
★পরিচিতি ★
◑ জন্মঃ- ২৫ শে এপ্রিল ১৭৯০
◑ শহীদঃ- ০৭ ই ফেব্রুয়ারি ১৮৩৩
◑ নামঃ- গঙ্গানারায়ণ সিং (ভূমিজ)
◑ পিতাঃ- লক্ষণ সিং
◑ মাতাঃ- মমতা সিং
◑ জন্মস্থানঃ- বাঁধডি(নিমডি,ঝাড়খণ্ড)
◑ গোত্রঃ – জাড়ু
◑ উক শ্মশানঃ- আমঝোর(জাড়ুখোল)
◑ এলাকায় পরিচিত নামঃ-সিংহাসুর
◑ আন্দোলনের নামঃ- ভূমিজ বিদ্রোহ(১৮৩২-৩৩)
◑ বিশেষ নামঃ- গঙ্গানারায়ণ হাঙ্গামা(১৮৩২-৩৩)
◑ বাহিনীর নামঃ- সরদার বাহিনী
◑ আন্দোলন ক্ষেত্রঃ- সমগ্র জঙ্গলমহল(১৮০৫)
👉 ইতিহাসে উপেক্ষিত শহীদ বীর গঙ্গানারায়ণ সিং :-
১৭৬৭-১৭৯৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে চুয়াড় (ভূমিজ সম্প্রদায়) বিদ্রোহের ভয়াভয়তা লক্ষ করে শঙ্কিত ব্রিটিশ সরকার ১৮০৫ সালে “জঙ্গলমহল” জেলা গঠন করে। ছোটনাগপুর, ঝাড়খণ্ড, জঙ্গলমহল, মানভুমই হোক না কেন এই জঙ্গলময় এলাকার ইতিহাস এক গৌরবময় ইতিহাস। ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের যে রক্তাক্ত ইতিহাস তার প্রথম সূত্রপাত জঙ্গলমহলের বরাভুম এলাকাতেই। এই এলাকার সমস্ত রাজারাই ছিলেন স্বাধীন, নয়ত অর্ধ স্বাধীন। জঙ্গলমহল জেলার সর্ববৃহৎ অংশ ছিল বরাভুম। পশ্চিমে পাতকুম, দক্ষিণ পশ্চিমে ছিল সিংভুম, দক্ষিণে ছিল ধলভুম, পূর্বে ছিল কুইলাপাল এবং মানভুম, উত্তরে ছিল পাঁচেৎ। ১৮৩৩ সাল পর্যন্ত এর প্রায় সমস্ত সীমান্তই ছিল ঘন জঙ্গলে আচ্ছাদিত।
বরাভুম রাজ পরিবার ঐতিহ্যগত উৎপত্তি পাতকুম রাজ পরিবার এবং এর পৌরাণিক প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বিক্রমাদিত্যের নামের সাথে নিবিড় ভাবে সম্পর্ক যুক্ত। (Ď.G.Manbhum 204, Story of NathVaraha & Ked Varaha)
পশ্চিম সিংভুম এর পটমদা থানায় রুপসান নামে গ্রামে রুপসান ডুংরী। এর উত্তরে রুপসান নদী ও লাউজোড়া, পশ্চিমে চিরুডি, দুঁদু ও বড়াম, দক্ষিণে বঁগই ও বেলডি, পুর্বে গটডি ও পাইনদা। বরাভুম রাজ পরিবারের প্রথম দুই যমজ সন্তান “নাথ বরাহ ও শ্বেত বরাহ বা কেশবরাহদেব একটি বরাহ কর্তৃক এই রুপসান ডুংরীতেই তার দুধ খেয়ে প্রথম প্রতিপালিত হয়েছিলেন। এই কারনেই পরগনাটির নাম “বরাভুম”।
এই বরাভুমের রাজ পরিবারের চল্লিশতম রাজা ছিলেন রাজা বিবেকনারায়ন। তিনিই ছিলেন এই রাজ বংশের শেষ স্বাধীন রাজা। ১৭৬৭ সালে চুয়াড় বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৭৭৫ সালে গৃহত্যাগ করেন। জোষ্ঠ পুত্র রঘুনাথ নারায়ণ কে সিংহাসনে মনোনীত করে গেলেও এই সময় থেকেই মূলতঃ একদিকে ব্রিটিশ উস্কানি এবং আর একদিকে ভূমিজ রীতিনীতির জটিলতায় শুরু হয়ে যায় এক দীর্ঘ কোন্দল। রাজা বিবেকনারায়ণের দুটি বিবাহ। প্রথম বিবাহে ছেলে লক্ষণ সিং (লছমন সিং) এবং দ্বিতীয় বিবাহের ছেলে রঘুনাথ নারায়ণ।
আদিবাসী ভূমিজদের নিয়মমতো প্রধানা বা পাটরানীর পুত্র, তিনি প্রথম জাত হোন বা নাই হোন, তিনিই হবেন পরবর্তী জমিদার বা রাজা। রঘুনাথ নারায়ণ যদিও ছিলেন অগ্রজ কিন্তু তিনি ছিলেন রাজার কনিষ্ঠা রানীর পুত্র আর এ কারনে সিংহাসনের প্রতি তাঁর দাবী ছিল অযৌক্তিক। বয়সে ছোট হলেও স্থানীয় নিয়ম নীতি সবকিছুই ছিল লক্ষন সিং এর অনুকুলে। কিন্তু স্থানীয় ভূমিজ আইন এবং জনসাধারনের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও উত্তরাধিকারের সংগ্রামে লক্ষন সিং শেষপর্যন্ত পরাজিত হন কারন ব্রিটিশ রাজশক্তি ছিল রঘুনাথ নারায়নের অনুকুলে। যাই হোক উত্তরাধিকারের নাহ্য দাবী থেকে বঞ্চিত করে লক্ষন সিং কে বরাভুম পরগনারই দক্ষিনে বাঁধগড় (বর্তমানে বাঁধডি) নামক অঞ্চলের জমিদারি দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে তাঁকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। লক্ষন সিং এই বাঁধগড়েই গড় নির্মান করে বসবাস শুরু করেন। ব্রিটিশ বিরোধিতার জন্য তাঁকে মেদিনীপুরের কারাগারে বন্দী করা হয় এবং ফার্গুসনের অত্যাচারে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
★ জন্ম ও বাল্যকাল ★
১৭৯০ সালের ২৫ শে এপ্রিল বাঁধগড় বা বাঁধডি নামক জায়গাতেই গঙ্গানারায়নের জন্ম। এই বাঁধডি জায়গাটি বর্তমানে নিমডি (ঝাড়খণ্ড) থানার অন্তর্গত। এর পূর্বে ডাহুবেড়া, খখর, গুমানডি, লংকাডুংরী, কুইয়ানি, বাঘরা, পশ্চিমে ফাঁগড়া, নিমডি ও রঘুনাথপুর, উত্তরে বনকাটি, সামানপুর, জাইড়াপাহাড়, বামনী, চেলিয়ামা ও রাইডি, বেড়াদা, দক্ষিনে পোড়াডি, কদমঝোর, মাকুলা ও মাকুলার জঙ্গল। চারিদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা, পাশেই দলমার দুর্গম পর্বত শ্রেণী। এমন পরিবেশেই বীর গঙ্গানারায়ণ সিং জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে তাঁকে খুশি রাখার জন্য ইংরেজদের প্ররোচনায় তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই রঘুনাথ নারায়ণ তাঁকে বাঁধডি গ্রামের জায়গীর দিয়ে তা দেখাশুনার দায়িত্ব দেন। এজন্য গঙ্গানারায়ণ কে বলা হত বাঁধডি গ্রামের ঘাটোয়াল। মাতা বিনম্র এবং ধর্ম পরায়না মহিলা হলেও কট্টর ইংরেজ বিরোধী ছিলেন। বীর গঙ্গানারায়নকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়বার অনুপ্রেরণা দিতেন। গঙ্গানারায়ণ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ইংরেজদের শাসন ও শোষন নিতির বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন।
প্রচণ্ড বিক্রমের জন্য পাতকুমের লোকেরা গঙ্গানারায়ণ কে বলতেন “সিংহাসুর”। তাঁর মন্ত্রী ছিলেন গোপীনাথ সিং, আর দুই তাঁর প্রধান সেনাপতিদ্বয় ছিলেন জিরপা সিং লায়া বা জিলপা সিং লায়া ও কিষণ সিং।
★ ইংরেজদের সঙ্গে বিরোধের কারণঃ———
রাজার দেওয়ান সুচতুর এবং ধড়িবাজ মাধব সিং একথা উপলব্ধি করেছিলেন যে, ব্রিটিশদের সাথে প্রতিরোধ গড়া নিরর্থক। বরঞ্চ ব্রিটিশদের সাথে সুসম্পর্ক থাকলে আখেরে অনেক লাভ। তিনি গঙ্গানারায়ণকে ব্যক্তিগত শত্রু মনে করে “পঞ্চ সর্দারী” তরফের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করেছিলেন। এছাড়া গঙ্গানারায়ণ একবার মাধব সিং এর কাছে স্ত্রী পুত্রকে রেখে ভ্রমণে যান, ফিরে এসে দেখেন মাধব সিং তাঁর (গঙ্গানারায়ণের) স্ত্রী, পুত্রকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে মাধব সিং এর উপর ক্ষুদ্ধ হন।
মাধব সিং সুদের কারবার এবং অন্যান্য আগ্রাসী কাজ কারবারের জন্য তিনি ছিলেন উপজাতিদের কাছে ঘৃনার পাত্র। বুদ্ধিবৃত্তিতে শ্রেষ্ঠ হলেও সুচতুর মাধবসিং তাঁর এই বুদ্ধিকে কেবলমাত্র নিজের ক্ষমতা এবং ব্যক্তিগত ধনসম্পদ বাড়াবার কাজে ব্যয় করেন। অন্যদিকে গঙ্গানারায়ণ তাঁর অপূর্ব সাংগঠনিক দক্ষতার জোরে সমস্ত উপজাতিদের মন জয় করেন।
এই সমস্ত কারনে মাধব সিং গঙ্গনারায়নের ব্যক্তিগত শত্রুতে পরিণত হয়েছিল। এই অত্যাচারী এবং সুচতুর মাধব সিং আবার ছিলেন ইংরেজদের মদতপুষ্ঠ। ইংরেজদের প্ররোচনাতেই গঙ্গানারায়ণকে “পঞ্চ সর্দারীর” অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন। এছাড়াও (১) কোম্পানীর উচ্চ হারে রাজস্ব। (২) ইংরেজদের জমি নীলাম প্রথা। (৩) জমি বিক্রয় আইন। (৪) দারোগা প্রথা। (৫) জঙ্গল কানুন। (৬) লবন কর প্রভৃতি কারনেও গঙ্গানারায়ণ ইংরেজদের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন।
★ বিদ্রোহের সূচনাঃ——–
ইংরেজদের মদতপুষ্ঠ অত্যাচারী ও নিষ্ঠুর মাধব সিং কে হত্যার মধ্য দিয়েই জ্বলে উঠেছিল বিদ্রোহের আগুন। দিনটি ছিল ১৮৩২ সালের ২৬ শে এপ্রিল। মাধব সিং চাণ্ডিলের কাছাকাছি শিরকা থেকে বামনীর রাস্তা দিয়ে বরাবাজারে গিয়েছিলেন। পথিমধ্যে বনডি এবং পলাশডির মাঝে “নাকটি থান” নামক জায়গায় গঙ্গানারায়ণ মাধব সিং কে হত্যা করেন।
এরপর গঙ্গানারায়ণ তাঁর অনুগামীদের নিয়ে ১৮৩২ এর ১লা মে বরাবাজারের মুনসিফ কাছারি লুঠ করেন, কোর্ট জ্বালিয়ে দেন। ভয়ে ভীত জমিদার গঙ্গাগোবিন্দ কোন উপায় না পেয়ে গঙ্গানারায়নের সমস্ত দাবী মেনে নিয়ে তাঁকে “পঞ্চ সর্দারীর” মালিকত্ব ফিরিয়ে দেন। এছাড়া গঙ্গানারায়নকে মাসোহারা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু পরদিনই গঙ্গানারায়ণ নিজ বীরত্ব প্রদর্শন করে বরাবাজারের পুলিশ থানা ভস্মীভূত করেন।
স্থানীয় ইংরেজ সৈন্যদের পক্ষে এরুপ সশস্ত্র সংঘর্ষের মোকাবিলার মত সামর্থ ছিল না। ইংরেজ সেনাপতি রাসেল বাঁকুড়ায় থাকতেন এবং তাঁর কাছে কোন বড় ধরনের সামরিক বাহিনীও ছিল না। অন্যদিকে বর্ধমানের কমিশনার ব্রাডন অসুস্থ ছিলেন। কাজেই রাসেল সর্বপ্রথম আলোচনার দ্বারা বিদ্রোহীদের সাথে মীমাংসার পক্ষপাতী ছিলেন এবং তদনুসারে ঘটোয়ালদের উদ্দেশ্যে পরোয়ানা জারী করে যুদ্ধ বিরতির আবেদন জানান। এই সময় গঙ্গানারায়ন ও তাঁর সৈন্যরা কোম্পানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য পাহাড় জঙ্গলে আত্মগোপন করে প্রস্তুত হন। এবিষয়ে ডেন্ট কোলকাতার ইংরেজ আধিকারিকদের জানান যে, “প্রায় প্রতিটি ভূমিজ, ঘাটোয়াল এবং রায়ত নির্বিশেষে গঙ্গানারায়নের দলে যোগদান করেছে। গঙ্গানারায়ণ ঘোষণা করেছেন যে তিনি দেশের সমস্ত পুলিশ থানাগুলি সূদুর বেনারস রোড পর্যন্ত ধবংস করে ফেলবেন।” ধলভূম, রাইপুর, সুপুর, অম্বিকানগর, কুইলাপাল, ধাদকা, দামপাড়া প্রভৃতি পরগনার জমিদারদের সাথে আত্মীয়তা ছিল তাঁদের সকলের সাহায্য নিয়ে।
★ গঙ্গানারায়নের অভিযানঃ————–
রাসেল পুঞ্চায় কয়েকদিন থাকার পর ৭ ই মে বরাবাজারে পৌছান। তিনি ব্যক্তিগত ভাবে বিদ্রোহী ভূমিজদের সাথে আলোচনা করতে চাইলেও তারা কেউ তাঁর কথায় কর্ণপাত করেনি। আলোচনার কোন আশা নেই দেখে পুনরায় ১৩ ই মে দূতের দ্বারা গঙ্গানারায়ণকে বার্তা দিয়ে আলোচনায় অগ্রসর হওয়া। ইতিপূর্বে ১২ ও ১৩ ই মে বিদ্রোহীরা যুদ্ধের নাকড়ার প্রতিধবনি ও বন্ধুকের গর্জন রাসেল তাবু থেকে শুনতে পান। ১৪ ই মে গঙ্গানারায়নের বাহিনী রাসেলের তাবু ঘিরে ফেলে। এই যুদ্ধে লেফটনান্ট ম্যাকডোনাল্ড বাহিনী বিদ্রোহী বাহিনীকে তাড়িয়ে দেয়। বহু লোক মারা যায়। ইতিমধ্যে ম্যাজিস্ট্রেট এবং কালেক্টর রাসেল গঙ্গানারায়নকে বিদ্রোহী বলে ঘোষণা করেন এবং তাঁকে জীবিত অথবা মৃত ধরে আনার জন্য প্রথমে ১,০০০/- (এক হাজার) এবং পরে ১,০০,০০০/- (এক লক্ষ) টাকা পুরস্কার ঘোষনা করেন। আবহাওয়াজনিত কারণ এবং রোগের ভয়ে কিছু ইংরেজ সেনা প্রত্যাহৃত হলেও ২ রা জুন মার্টিনের নেতৃত্বে এক বিশাল বাহিনী বিদ্রোহীদের মূল আস্তানা বাঁধডি অভিমুখে যাত্রা করেন। ৪ঠা জুন মার্টিনের বাহিনীর উপর তীর বর্ষন শুরু হয় এবং ১৯ জন সিপাহী ঘায়েল হন। ইংরেজ বাহিনীর খাদ্য সামগ্রী গঙ্গানারায়নের বাহিনী লুট করে নেয়। প্রচন্ড গরম এবং বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড়ী এলাকায় ব্রিটিশ বাহিনী ব্যতিব্যস্ত হয়ে যায়। ব্যর্থ হয়ে বরাবাজারে পালিয়ে আসেন মার্টিন ও কমিশনার কে লেখেন “বৃষ্টির কারনে সেনা তুলে নেওয়া হয়েছে।” ক্যাপ্টেন ইম্পে, লেফঃগ্রাহাম এবং লেফঃউইলসন অসুস্থার কারনে কিংবা ভয়ে ছুটি নিয়েছিল।
২৫ শে জুলাই গঙ্গানারায়ন কুইলাপালের জমিদার বাহাদুর সিং এর সাহায্য নিয়ে প্রায় এক হাজার বিদ্রোহী সমেত পুঞ্চাতে ইংরেজদের আক্রমন করেন। ২৬ শে জুলাই একই ভাবে তিন হাজার বিদ্রোহী নিয়ে তিনি সুপুর, রাইপুর পরগনায় ইংরেজদের আক্রমন করেন। অম্বিকানগর থানা পুড়িয়ে দেন। লড়াই এর দিন গুলিতে অম্বিকানগর, আঁকরো, সুপুর, ফুলকুশমা, শ্যামসুন্দরপুর, কুইলাপাল, রাইপুর, ধলভুম প্রভৃতি এলাকার জমিদারও গঙ্গানারায়নের পাশে দাঁড়ান।
পরবর্তীকালে ভূমিজদের এই দুর্ধর্ষ বাহিনী জঙ্গলমহলের বাগদা পরগনা, শিলদা ও কুইলাপালের ভূমিজেরাও যোগদান করেন। বাঁকুড়া থেকেও কোন পুলিশ বাহিনী এই বিদ্রোহী ভূমিজদের দমনের জন্য পাঠান হয়নি। কাজেই এই মুহুর্তে গঙ্গানারায়ণকে বাধা দেওয়ার মত সামর্থ কারও ছিল না।
ইংরেজ বাহিনীর এরুপ দুর্বলতা ও অব্যবস্থার ফলে গঙ্গানারায়নের ক্ষমতা ও ঔদ্ধত্য ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। সমগ্র জঙ্গলমহল অতিক্রম করে গঙ্গানারায়ণ মেদিনীপুর জেলার মদগ্যে প্রবেশ করলে শিলদা, বলরামপুর ও প্রতিবেশী পরগনাগুলিতে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। মেদিনীপুর থেকে অভিযান প্রতিরোধের চেষ্টা হয়। গঙ্গানারায়নের বাহিনী রঘুনাথ সিং এর নেতৃত্বে বাহিনী বরাবাজারের দিকে যাত্রা করে। ফলে বিদ্রোহী ভূমিজেরা বরাভুমের উত্তরে পঞ্চকোট জমিদারীতে হানা দেয়। গঙ্গানারায়নের আগমনে বিদ্রোহী ভূমিজ বাহিনী বিনা বাধায় গোপালনগর, পুঞ্চা ও বাগদা আক্রমণ করে।
বরাভুম এবং কাশীপুর পরগনাতে, বেড়মার ঘাটোয়াল সর্দারদের সাহায্য নিয়ে বলরামপুর, আদাড্ডিতে, বড়চাতরমায় ইংরেজ বাহিনীর সাথে গঙ্গানারায়নের সংঘর্ষ হয়। অন্যদিকে ইংরেজ বাহিনী বলরামপুর থেকে বরাবাজার, বরাবাজার থেকে বেড়াদা এবং অপরটি ধাদকা থেকে আমচুড়ি পর্যন্ত দুটি অভিযান চালান। দুটি অভিযানই ছিল বরাভুমের গঙ্গানারায়ণ এবং ধলভুমের রঘুনাথ সিং এর বিরুদ্ধে।
১৮৩২ এর সারা ডিসেম্বর মাস ধরে চলতে থাকে ব্রিটিশ তান্ডব। রায়ডি এবং দিগারডি গ্রাম দুটি পুড়িয়ে দেয়। বেঁড্যাডি এবং বেড়াদায় ঘর বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। বাঁধডি এবং তৎসংলগ্ন পাহাড়গুলিকে ইংরেজ ফৌজ ঘিরে রাখলে গঙ্গানারায়ণ গভীর জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। ইংরেজ বাহিনী দলমা পাহাড় ঘিরে রাখে। এই সময় গঙ্গানারায়ণ সিংভুমে আশ্রয় নেয়।
এই সময় ইংরেজ বাহিনী বিদ্রোহীদের দমনের প্রস্তুতি নেয়। সাথে সাথে বাংলাদেশ সরকার বিদ্রোহী নেতাদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। ডেন্টের নেতৃত্বে ইংরেজ বাহিনী গঙ্গানারায়নের প্রধান সমর্থক ও বিদ্রোহীনেতা জিরপা লায়াকে আক্রমণ করে। ইংরেজ বাহিনী বিদ্রোহীদের প্রধান কেন্দ্রস্থল বেড়াদা গ্রামটি ধবংস করেন। পাতকুম নিবাসী ভূমিজ বিদ্রোহী তুলশী দিগার ও বেড়া সিং এর গ্রাম ধবংস করে।
আক্রমণের পরিকল্পনা অনুসারে ইংরেজ বাহিনীকে তিনভাগে ভাগ করা হয়। ১৮৩৩ সালের ২ রা ফেব্রুয়ারি ভূমিজ বিদ্রোহের বেশ কিছু নেতা নিহত হয়। ইংরেজ বাহিনীর এরুপ সমরসজ্জা ও ক্রমাগত জয়লাভের মাঝে হঠাৎ ৭ ই ফেব্রুয়ারি গঙ্গানারায়নের মৃত্যু সংবাদ আসে। সিংভূমে পালিয়ে যাওয়ার সময় খরসোয়ান এর ঠাকুর চৈতন সিং এর সেনাদের দ্বারা নিহত হন।
গঙ্গানারায়ণ সম্পর্কে ইংরেজরা এতই ভীত ছিল যে তাঁর জামাতা, অনেক আত্মীয় সহ একশত লোক দ্বারা তারা গঙ্গানারায়নের ছিন্ন মস্তকটি সনাক্ত করেছিলেন।
মনে রাখতে হবে এ লড়াই গঙ্গানারায়ণ সিং এর সঙ্গে সুপুর, শ্যামসুন্দরপুর, শিলদা, কুইলাপাল, দামপাড়া, ধলভুম, ধাদকা, রাইপুর এলাকার রাজা, জমিদার এবং জাতি উপজাতি নির্বিশেষে সমস্ত শোষিত মানুষ একযোগে অত্যাচারী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গঙ্গানারায়নের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আজ গঙ্গানারায়ণ নেই, তাঁর নির্মিত গড় রাজাঘুটার ইঁট, পাথরের ঢিপিতে পরিনত, কিন্ত দলমার কোলে কোলে আবাল বৃদ্ধবনিতা সবার মুখে মুখে এখনো ঘোরে তাঁর বীরগাথা। আর তাঁর স্মৃতির নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে সেই সাতখাটিয়া, ধান আড়াল, গঙ্গাজুইড়া আর চামু ডুংরী।
যাইহোক এই ভূমিজ বিদ্রোহের ফলে যৌথ কমিশনার ডেন্টের প্রস্তাব অনুসারে জঙ্গলমহল জেলাকে ভেঙ্গে দেওয়া হয়। ১৮৩৩ সালের ১৩ নং রেগুলেশন অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেনপাহাড়ি, শেরগড় ও বিষ্ণুপুর অঞ্চল কে বর্দ্ধমানের সাথে যুক্ত করা হয় এবং মানবাজারকে সদর-দপ্তর ঘোষণা করে নতুন মানভুম জেলার সৃষ্টি হয়। এই নতুন মানভুম জেলা সুপুর, রাইপুর, অম্বিকানগর, ছাতনা, শিমলাপাল, মহেশ্বরা, ভেলাইডিহা, ফুলকুশমা, শ্যামসুন্দরপুর, ধলভুম, বরাভুম, বেগুনকোদর, বাঘমুন্ডি, হাসলা, ঝালদা, ঝরিয়া, নোয়াগড়, কাশীপুর, কুইলাপাল,পাতকুম, তোড়াং এবং মানভুম (মানবাজার) নিয়ে গঠিত হয়। ১৮৩৩ সালে এই নতুন জেলা গঠনের সময় বাঁকুড়া শহরও মানভুমের অন্তর্গত ছিল, কিন্তু ১৮৩৪ সালে বাঁকুড়া শহরকে বর্দ্ধমানের সাথে যুক্ত করা হয়। শেষ পর্যন্ত মানভুম জেলার পূর্ব্বাংশ নিয়ে ১৮৮১ সালে এক নতুন জেলা রুপে বাঁকুড়া আত্মপ্রকাশ করে।
মূল সূত্রঃ ভূমিজ রিভোল্ট – জগদীশ চন্দ্র ঝা।
মানভুমে চুয়াড় বিদ্রোহ -সুভাষ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
মানভুম কথা ও অন্যান্য গুনিজনের সাহায্য নিয়ে।
🌾জোহার।। জয় ভূমিজ।। জয় আদিবাসী।। জয় ভারত🌾